মোশারফ হোসেন বাবু
আদর্শের মৃত্যু নেই। আদর্শের রস (আদরশ) আর দর্শন বা ধর্ম দর্শনের রস (দরশন) বস্তুত অভিন্ন । পৃথিবীর সব বিবেকবান মানুষই এই আদর্শের রস পান করে সুস্থ থাকেন, ভাল থাকেন।
‘মুজিববাদ বা মুজিবাদর্শ তেমনি একটি আদর্শ। জোলিও কোরী শেখ মুজিব পৃথিবীর সব দর্শনের ‘রস’ পান করে মুজিবাদর্শ প্রকাশ, প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছিলেন- যা বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে সংযোজন করা হয়েছিল। চারটি আর্দশের সমন্বয়ে মুজিববাদ বা মুজিবাদর্শ গঠিত। এগুলো হচ্ছে (১) জাতীয়তাবাদ, (২) ধর্ম নিরপেক্ষতা (৩) গণতন্ত্র ও (৪) সমাজতন্ত্র। শান্তির দূত শেখ মুজিব, UNO, OIC, Common Wealth সহ আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গনের সর্বক্ষেত্রে অনুপম বাক শিল্পের মাধ্যমে এই চারটি আদর্শকে অবলম্বন করে বিমূর্ত বিশ্ব শান্তিকে মূর্তিমান করার চেষ্টা করে গেছেন নিরন্তর ভাবে। পৃথিবীর দ্বন্দ্ব সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘর্ষের অবসান ঘটানো বিরোধপূর্ণ এলাকায় শান্তি স্থাপন, বিশ্বের পরিবেশবাদীদের উৎসাহীকরন, অস্ত্র সীমিত করন ও নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে উনার সৌমার্জিত উপস্থিতি ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে ফিডেল কেস্ট্রো একবার বলেছিলেন, ‘আমি হিমায়ল দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছি।
চিহ্নিত সমস্যার সমাধানের প্রয়োজনেই, আদর্শের উদ্ভব ঘটে। বঙ্গবন্ধুর বিপুল জনপ্রিয়তা ও স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় তাই প্রমাণীত হয়। কারণ মুজিববাদের বিকল্প আদর্শ তখনো বাঙ্গালীর সামনে ছিলনা বা এখনো নেই। চীনা নেতা ডা. সান ইয়াৎ সেন এবং ইন্ডিয়ান নেতা পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু অনেক চিন্তা-ভাবনা করে নিজ নিজ দেশের জন্য যে রাষ্ট্রদর্শন গ্রন্থিত করেছিলেন তার সাথে মুজিবদর্শনের হুবহুব মিল রয়ে গেছে। এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, স্নায়ুযুদ্ধের (ঈড়ষফ ডধৎ)উত্তেজনা প্রশমনকারী বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের এবং আন্দোলনে অংশগ্রহনকারী অসংখ্য দেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবেও এই চারটি আদর্শ স্বীকৃতি পেয়েছিল। কারণ উনাদের সকলেরই প্রেক্ষিত, বাস্তবতা ও লক্ষ্য ছিল প্রায় অভিন্ন।
অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ‘মুজিববাদ’ একটি সফল রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পৃথিবীর পরিবেশবাদী আন্দোলনে ও বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে। সর্বশেষ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে করোনায় আক্রান্ত বিশ্বের আর্থ-সামাজিক পূর্ণগঠনের জন্য উনার প্রস্তাবিত ৬ দফা হচ্ছে মুজিববাদেরই আধুনিক সংস্করন। তাই প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড বা বাংলাদেশের মুজিববাদের সাথে বিশ্বায়নের সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনা অবশ্যই গুরুত্বের দাবী রাখে।
জাতীয়তাবাদ ঃ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বৃদ্ধিপাচ্ছে জাতীয়তাবাদী উগ্রতা অসহিষ্ণুতা বা হিংস্রতা যা এষড়নধষ ঠরষষধমব এর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকী হিসেবে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিকতাবাদের ভিত্তি হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। বিশ্বের জাতি সমূহের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ব্যতীত বিশ্বের রাজনৈতিক সমস্যা সমূহের সমাধান সম্ভব নয়। এই কারণে বঙ্গবন্ধু জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ প্রদান করেন যা গোটা বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষন প্রদানের সত্যিকারের সাফল্য আসে সেদিন, যেদিন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করে। কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই সিদ্ধান্তকে বঙ্গবন্ধু সম্মান করতেন যে, সাফল্যমন্ডিত জাতীয়তাবাদই শুধুমাত্র আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে পারে।
এখানে উল্লেখযোগ্য, বঙ্গবন্ধুর বিশেষ নির্দেশেই বিশ্বের সর্বাধুনিক সংবিধান বাংলাদেশের সংবিধানে বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতার বিষয়টি সন্নিবেশিত করা হয় এবং খবধমঁব ড়ভ ঘধঃরড়হং এবং টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঙৎমধহরুধঃরড়হ এর প্রতিষ্ঠাকালীন সময়েও বিশ্বের জাতি সমূহের আত্মনিয়ন্ত্রনাধীকারের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শুধু একজন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী নন বরং একটি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের স্থপতি, যে কারনে তিনি কাছ থেকে উপলব্ধি করেছিলেন জাতীয়তাবাদী পারস্পরিক সম্পর্কে চিত্রিত বিশ্বায়নের স্বরূপ ও তার মর্মবানী, যা হল আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি।
যে ভাষার জন্য বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে কারাবরণ করেছিলেন সেই ভাষা বিজ্ঞানেও পৃথিবীর মানুষের ঐক্য ও প্রতিজ্ঞার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। যেমন; আন্তর্জাতিকতাবাদ এই শব্দটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি হচ্ছে ‘অন্তর’ ‘জাতি’ ‘বাদ’- অর্থাৎ অন্তরে জাত বা অন্তর্জাত ধ্যান-ধারণা পরিবার, সমাজ ও দেশের সীমানা অতিক্রম করেই বিশ্ব পরিসরে গৌরব ময় আসন লাভ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সাফল্য নয়া উপনিবেশবাদী নীল নকসায় বস্তুত কংকালে পরিণত হয়। আজো উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশ সমূহের পারস্পরিক সংলাপে বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদ একটি দিক নির্দেশকের ভূমিকা পালন করছে।
২। গণতন্ত্রঃ- গণতন্ত্র বলতে জনগনের শাসন বুঝালেও জাতিসংঘে গণতন্ত্রের প্রতিফলন ঘটছেনা। মানব জাতির দূর্ভাগ্য যে, বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র নিমার্তা ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের নেতৃত্বে L.N.(League of Nations) and UNO (United Nations Organization)’র মত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছিল। টঘঙ,র সর্বাধিক ক্ষমতাশালী অঙ্গ ঝবপঁৎরঃু ঈড়ঁহপরষ এর এ যাবৎকালের কাজ কর্ম পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় ইরম ভরাব বা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের স্বার্থের বাইরে এই পরিষদের বিশেষ কোনো কাজ নেই। পৃথিবীর বা মানব জাতির নিরাপত্তার শ্লোগান দিয়ে এবং নিরপত্তা পরিষদ নাম নিয়ে এই পরিষদ কার্যত পৃথিবীর শান্তিকে অশান্তিতে রূপান্তরিত করে চলেছে ধারাবাহিক ভাবে। বস্তুত, বিশ্বায়নের সমস্ত অন্তরায় সমূহ এই ইরম ভরাবএর হাত কোন না কোন ভাবে পরিমার্জন ও পরিপুষ্টি লাভ করছে। তাদের ঠবঃড় ভোট প্রদানে ও ঠবঃড় ভোট প্রদান বিরত থাকায় উভয় ক্ষেত্রেই শুধু তাদের স্বার্থই সংরক্ষিত হয়েছে। এই ইরম ভরাব এর সদস্যরা আজ প্রকাশ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে বিশ্বব্যাপী ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগীতায় লিপ্ত- যা কোন ভাবেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয় বরং মারনাস্ত্র ও কূট-রাজনীতির ভূমিকাই বেশী পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর ঠবঃড় ক্ষমতা তাদেরকে করে তুলেছে অপ্রতিরোধ্য। অথচ পঁুজিবাদী রাজনৈতিক চরিত্র ঐতিহাসিক ও ত্বাত্ত্বিকভাবে গণতান্ত্রিক হতে বাধ্য; অন্যথায় থেকে যায় বিপর্যয়ের নিশ্চয়তা। যেমন, শিল্প বিপ্লব পরবতর্ী বিশ্ব রাজনীতিতে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়া ও সামন্তবাদী প্রবনতা বৃদ্ধিপাওয়ার কারণে ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল। আজকে নয়া উপনিবেশবাদী অস্ত্র প্রতিযোগীতার সময় জাতি সংঘের মত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক চরিত্রের হতে হবে। ঠবঃড় ক্ষমতার বিলুপ্তি সহ জাতি সংঘের সকল সিদ্ধান্ত গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গ্রহন ও বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। ‘গণতন্ত্র’ শব্দের ‘গণ’ মানবিক মূল্যবোধের স্মারক। তাই গণতন্ত্রের ‘গণ’ই পারে আজ পৃথিবীর জনগণের ‘গণ’ এর নিরাপত্তা দিতে।
৩) ধর্ম নিরপেক্ষতা ঃ বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বুঝায় কোন বিশেষ ধর্মের স্বার্থ সংরক্ষন না করে সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশ করা। অর্থাৎ পৃথিবীর আর্থ-সামজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সমূহকে চিহ্নিত করণ ও সেসবের সমাধান অনুসন্ধানে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করা।
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ‘লাকুম দীনওকোম অল ইয়াদীন’ অর্থাৎ যার যার ধর্ম তার তার কাছে; পবিত্র কোরআন শরীফের এই বানীই হচ্ছে মুজিববাদী রাজনৈতিক দর্শনের প্রাণ স্পন্দন। ইসলামী মূল্যবোধে ঋদ্ধ শেখ পরিবারের সন্তান শেখ মুজিব বাংলাদেশে ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি এই দেশের জন্য ঙওঈ (ঙৎমধহরুধঃরড়হ ড়ভ ওংষধসরপ ঈড়হভবৎবহপব) এর সদস্য পদও অর্জন করেছিলেন। নিজ নিজ ধর্মকর্ম অনুসরণ করা যেমন পরধর্ম বিরোধীতা নয়, তেমনি অকারণে পরধর্ম বিরোধীতা করাও নিজ ধর্ম কর্ম নয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে এই সত্যটি সব সময়ই প্রাধান্য পেয়েছে যা নাস্তিক্যবাদ ও জঙ্গিবাদ উভয় প্রকারের উগ্রতা থেকে মুক্ত।
বড় বড় যুদ্ধরাজরা অতীতে ধর্মকে ব্যবহার করেছে ভবিষ্যতেও করার চেষ্টা করবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে ইসলামী খেলাফত বিপন্ন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ ইহুদীদের হত্যা করা হয়। দীর্ঘদিনের ইজরাইল, ফিলিস্তিন ও রোহিঙ্গা সমস্যার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আজো স্থায়ী সমাধান সম্ভব হচ্ছে না। যা আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতিকে ভীষনভাবে প্রভাবিত করছে। এ সব কারণে বঙ্গবন্ধুর ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শ বিশ্বায়নের জন্য অপরিহার্য্য হয়ে ওঠেছে।
৪) সমাজতন্ত্র ঃ বিকশিত সমাজ ভাবনার একটি সমৃদ্ধ পর্যায়ে পুঁজিবাদী শাসন ও শোষনের প্রতিঘাত স্বরূপ সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার উন্মেষ ঘটেছিল। ভাষা বিজ্ঞান বা সমাজদর্পনে বিবেকবান মানুষ নিজস্ব স্বরূপ বা সত্তা আবিস্কার করে বলে উনাদের সমাজ মূখী ভাবনার স্রোত এতটাই প্রাবল্য লাভ করে যে, বিভিন্ন ধর্মীয় অর্থনীতিকেও উনারা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় ব্যাখ্যা করে থাকেন। যেমন, ইসলামী সমাজতন্ত্র, খ্রিষ্টীয় সমাজতন্ত্র বৌদ্ধীয় সমাজতন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও লড়াই কর’- এই শ্লোগান সত্ত্বেও পৃথিবীর সমাজতন্ত্রীরা এক হতে পারে নাই। কার্ল মার্কস এর সমাজতন্ত্রকে লেনিনম, স্টালীন, মাওসেতুং, দেং জিয়াও পেং, মার্শাল টিটো প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ করে গেছেন। শ্রেণীহীন সমাজের কথা বললেও সমাজতন্ত্রে কার্যত আরেকটি শাসক শ্রেনীর জন্ম হয়, যাদের সাথে সমাজের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা বা সাংস্কৃতিক ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। মহাজ্ঞানী কার্ল মার্কস এর প্রতিটি গবেষণাই মহা মূল্যবান এবং কালজয়ী; শুধুমাত্র নাস্তিক্যবাদ ছাড়া। কাল্পনিক নাস্তিক্যবাদকে তিনি উনার সকল বিজ্ঞান গবেষণায় রাজমুকুটের মত ব্যবহার করেছেন। যেহেতু পুঁুজিবাদী শোষণ ও সমাজতান্ত্রিক লুন্ঠন বৃত্তি কোনটাকেই ধর্ম সমর্থন করেনা সম্ভবত এই কারনেই মার্কস ধর্মের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। নাস্তিক্যবাদ ঐশীধর্ম (ইসলাম, খ্রিষ্টান, ইহুদী, হিন্দু ইত্যাদি) বিরোধী হওয়ায় প্রকারান্তরে তা শান্তি বিরোধী। আর এ কারনেই শান্তির অন্বেষণে ধাবমান ‘পৃথিবীর রথকে (পরথব) মার্কসবাদ দেখাতে পারছেনা কোন দিক নিদের্শনা। এছাড়া যুগ যুগ ধরে পুঁজিবাদী শোষণের সঞ্চিত সম্পদ সমাজতন্ত্রীরা বিপ্লবের নামে লুট বা আত্মসাৎ করে নেয়। কিন্তু ‘অর্থনীতি’ শব্দের নীতি কোন ভাবেই লুন্ঠন প্রবৃত্তিকে সমর্থন করে না। এ সব কারণে ঐশী ধর্মগ্রন্থ সমূহে বর্ণিত অর্থনৈতিক নীতিমালার প্রতি মানুষের আগ্রহ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র ছিল , না নাস্তিক্যবাদী না লুন্ঠনবাদী। এই সমাজতন্ত্র হচ্ছে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার নিরন্তর সংগ্রাম। শতাব্দীর পর শতাব্দী বিদেশী শাসন শোষণে নিঃস্ব বাংলার মানুষের মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে তিনি রাজনীতি শুরু করেছিলেন এবং মানুষের মেধা ও দক্ষতার সঠিক পরিচর্যা ও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র বা কাঠামো নির্মানে সর্বস্ব বিনিয়োগ করেছিলেন। মুজিববাদী সমাজতন্ত্র আজকের পৃথিবীতে পূর্ববর্তী যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী প্রাসঙ্গিক। কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ ও বানিজ্যযুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিশ্ব মহামন্দার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই করোনার (ঈড়ারফ-১৯) ভয়াল থাবায় আবার এখন ধরাশায়ী। এই ভঙ্গুর অর্থনীতির পূণঃরুজ্জীবনের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় বিচারের মানদন্ডই সর্বাধিক নিরাপদ। মেধা, সততা, সাধুতা, নিষ্ঠা ইত্যাদি মানবিক জ্ঞানে গুনী, সারথীদের পক্ষেই শুধুমাত্র ‘অর্থনীতির ‘রথ’ (অরথনত) পরিচালনা করা সম্ভব। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় বিচারবিহীন অতীতের অভিজ্ঞতা অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার পূণঃরাবৃত্তি ঘটুক ভবিষ্যতের নিকটতর দিগন্তে-এটা কোন ভাবেই কাম্য হতে পারে না।
ঐশী ধর্মগ্রন্থ সমূহ যে সকল ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল সেই সব ভাষা বা ভাষাতত্ত্ব হচ্ছে সেই সব ধর্মগ্রন্থ সমূহের ব্যাপকতর ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের উর্বরা ক্ষেত্র। কিন্তু মানব সমাজের সমস্যা চিহ্নিত করণ ও সমাধানের জন্য উদ্যোগ নিয়ে যারা সফল হয়েছেন তাদের সাথে ধর্ম বা ধর্মসমূহের বিশেষ কোন বিরোধ নাই। শেখ মুজিব তাদেরই একজন। এ পর্যন্ত বিশ্বে যে নেতাকে নিয়ে সর্বাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে উনার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি, পুরস্কার বা নিন্দার জন্য অপেক্ষায় না থেকে মুজিব বাদ পরমাদর্শের প্রতি সম্মান জানিয়ে বিশ্ব মানবের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে থাকবে ‘হাজার বছর ধরে’।